এসো সুখী পৃথিবীর জন্য লড়ি—চার্লি চ্যাপলিন


ছোটখাটো দুই পায়ে বিশাল আকারের জুতা। হাতে বেতের ছড়ি, বিশেষ ভঙ্গিতে ছাঁটা গোঁফে গুঁজে রাখা চুরুট, গোল হ্যাট আর আঁকা কালো দুই চোখ—এই আমাদের পরিচিত, প্রিয় চার্লি চ্যাপলিন। তাঁর পুরো নাম চার্লস স্পেন্সর চ্যাপলিন। চ্যাপলিনের উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র: দ্য সার্কাস, মডার্ন টাইমস, দ্য কিড, সিটি লাইটস, মঁসিয়ে ভেরদু, দ্য গ্রেট ডিক্টেটর প্রভৃতি। মনে করা হয়, দ্য গ্রেট ডিক্টেটর (১৯৪০) হিটলারকে ব্যঙ্গ করে নির্মিত। এ সিনেমায় চ্যাপলিন একটি বক্তৃতা দেন। বহু বছর পার হলেও আজও ভাষণটি তাঁর প্রেক্ষিত হারায়নি।sam
let's fight for a happy world 
আমি খুবই দুঃখিত, তবে এটা সত্যি যে আমি কখনোই সম্রাট হতে চাইনি। এটা আমার কাজ নয়। আমি কাউকে শাসন কিংবা অধস্তন করতে চাই না। বরং আমি সবাইকে সাহায্য করতে চাই, তা সে ইহুদি, খ্রিষ্টান, সাদা, কালো যে-ই হোক না কেন।sam 
মানুষ মাত্রই একে অন্যকে সাহায্য করতে চায়। পরস্পরকে সুখী করার মধ্য দিয়ে বাঁচতে চায়। অন্যকে কষ্ট দিয়ে আমরা কখনোই সুখী হতে পারি না। কাউকে ঘৃণা করেও সুখী হওয়া যায় না। সেই সঙ্গে এটাও সত্যি, পৃথিবীটা সব মানুষের। প্রভু এটাকে যথেষ্ট সম্পদশালী করে তৈরি করেছেন। প্রতিটি প্রাণীর ভরণপোষণের সামর্থ্য এ পৃথিবীমাতার আছে। পাশাপাশি প্রভু আমাদের প্রত্যেককে স্বাধীন ও সুন্দর জীবনযাপনের অধিকারও দিয়েছেন।sam

কিন্তু দুর্ভাগ্য, আমরা জীবনযাপনের সেই স্বর্গীয় পথটি হারিয়ে ফেলেছি। লোভ মানুষের আত্মাকে কলুষিত করে ফেলেছে, বিশ্বকে ঘৃণায় ছেয়ে ফেলেছে, আমাদের দুর্ভাগ্য আর যুদ্ধে ঠেলে দিয়েছে। আমরা জীবনে গতি এনেছি ঠিকই, কিন্তু নিজেদের আত্মাকে বন্দী করে ফেলেছি। যন্ত্রের আবিষ্কার আমাদের মধ্যে অপরিসীম চাওয়ার জন্ম দিয়েছে। জ্ঞান আমাদের হতাশাবাদী করে তুলেছে। আমাদের নির্মম ও কঠোর করে তুলেছে। আমরা অনেক কিছু ভাবি, কিন্তু অনুভব করি খুব কম। তাই এখন আমাদের আধুনিকতার অনুষঙ্গ নানা রকমের যন্ত্রপাতির চেয়েও বেশি প্রয়োজন মানবিকতা। বুদ্ধির চেয়ে বেশি প্রয়োজন অন্যের প্রতি মমতা ও বিনয়। এসব মানবিক গুণ ছাড়া জীবন দুর্বিষহ হয়ে পড়বে, হারিয়ে যাবে সব অর্জন।
অ্যারোপ্লেন কিংবা রেডিও—বিশ্ববাসীকে কাছাকাছি এনে দিয়েছে, পৃথিবীকে ছোট করে দিয়েছে। এসব আবিষ্কারের মূল উদ্দেশ্য ছিল মানবকল্যাণ, বিশ্ব ভ্রাতৃত্ববোধ, সবার মধ্যে ঐক্যের বন্ধন। এসব আবিষ্কারের ফলেই এ মুহূর্তে আমার কণ্ঠও পৌঁছে যাচ্ছে সারা বিশ্বের লাখ লাখ নারী-পুরুষ, নিপীড়িত মানুষের কাছে। পৃথিবীর যে প্রান্তেই হোক, আমার কণ্ঠ যে শুনতে পাচ্ছে, তাকেই বলছি: হাল ছেড়ো না।sam
আজ আমরা যে দুঃসময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি, মানবকল্যাণবিমুখ কিছু মানুষের ঘৃণা ও লালসার কারণে চারদিকে যে আঁধার নেমে এসেছে, তা চিরকাল থাকবে না। জনগণের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া ক্ষমতা আবার তাদের কাছেই ফিরে আসবে। আর মানুষের অস্তিত্ব যত দিন থাকবে, আত্মার স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষাও তত দিন বেঁচে থাকবে মানুষের মাঝে।
আর সৈনিক ভাইদের বলছি: তোমাদের অধিনায়কেরা তোমাদের দাস বলে মনে করে। তারা তোমাদের জীবন নিয়ন্ত্রণ করে, তোমরা কী করবে, কী করবে না, কী ভাববে, কী অনুভব করবে—এ রকম সবকিছু নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে, তোমাদের সঙ্গে গবাদিপশুর মতো ব্যবহার করে। তাদের কাছে নিজেদের বিকিয়ে দিয়ো না। এসব কৃত্রিম মানুষের হূদয় বলে কিছু নেই, যান্ত্রিকভাবেই তারা ভাবে, বোঝে। কিন্তু তোমরা তো যন্ত্র নও। তোমরা গবাদিপশু নও। তোমরা মানুষ। তোমাদের হূদয়ে মানুষের জন্য ভালোবাসা সঞ্চিত রয়েছে। মানুষকে তোমরা ঘৃণা করতে পারো না। তোমরা বরং ঘৃণা করো মিথ্যা ও যান্ত্রিকতাকে। তাই বলছি, সৈনিক ভাইয়েরা, দাসত্বের জন্য যুদ্ধ কোরো না, বরং লড়াই করো স্বাধীনতার জন্য।
আর যারা সাধারণ মানুষ, তাদের বলছি: তোমাদের যেমন নতুন নতুন যন্ত্রপাতি আবিষ্কারের ক্ষমতা রয়েছে, তেমনি তোমরাই পারো সুখের সন্ধান দিতে। তোমাদের আছে জীবনকে স্বাধীন ও সুন্দর করে তোলার ক্ষমতা। জীবনকে এক রোমাঞ্চকর অভিযাত্রা করে তোলার ক্ষমতা। তাই এসো, আমরা একত্র হই, সংগঠিত হই। একটা নতুন, স্বর্গীয় পৃথিবী গড়তে লড়াই করি। এ লড়াই তারুণ্যকে দেবে একটা নিশ্চিত ভবিষ্যৎ, বার্ধক্যকে দেবে নিরাপত্তা। এসো, এ লড়াইয়ে নামার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হই।sam
চলো, লড়াই করি স্বাধীন একটি পৃথিবীর জন্য। অতিক্রম করে যাই দেশ-কালের বাধা। ভেঙে ফেলি লোভ, ঘৃণা, অসহিষ্ণুতার বেড়াজাল। লড়াই করি এমন একটি পৃথিবীর জন্য, যেখানে যুক্তি ও বিজ্ঞান মানুষকে এগিয়ে চলার পথ দেখাবে। মানুষের এই অগ্রগতিই তাকে সুখী করে তুলবে। আর এগিয়ে চলার আকাঙ্ক্ষা মানুষকে সুখী করে তুলবে। এমন একটি সুখী জীবনের জন্য এসো আমরা একত্র হই।sam
মনে রেখো, মেঘ একসময় কেটে যায়, সূর্য আলো ছড়ায়। আমরাও তেমনই অন্ধকারের জাল ছিঁড়ে আলোর মুখোমুখি হব। আমরা এক নতুন পৃথিবী গড়ব। আমরা এমন এক স্নিগ্ধ উজ্জ্বল পৃথিবী গড়ব, যেখানে মানুষ তার লোভ, নিষ্ঠুরতাকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যাবে, ছাড়িয়ে যাবে নিজেকে। মানুষের আত্মাকে ওড়ার ক্ষমতা দিয়েছেন প্রভু। তাই শেষ পর্যন্ত সে তার ডানা মেলে দেবেই। সে উড়ে যাবে রঙিন রংধনুর দিকে, আশার আলোর দিকে, উজ্জ্বল ভবিষ্যতের পানে। এমন অসীম ক্ষমতাধর আত্মা বিরাজ করে তোমার, আমার, আমাদের সবার মধ্যে। তাই হতাশ হোয়ো না, বরং সাহসী হও বন্ধু।sam

উৎস

No comments :