পাখির মুখে মানুষের হারিয়ে যাওয়া ভাষা

জার্মান অভিযাত্রী ও প্রকৃতিবিজ্ঞানী আলেকজান্ডার ফন হামবোল্ট (১৭৬৭-১৮৩৫) সম্পর্কে গ্যেটে বলেছেন, ‘সত্যিকারের সম্পদ দিয়ে তিনি আমাদের অবগাহন করিয়েছেন’, আর নেপোলিয়ন বোনাপার্ট বলেছেন, ‘আপনিও দেখছি আমার স্ত্রীর মতো গাছপালা, পাখপাখালি নিয়ে পড়ে আছেন।’
ভেনেজুয়েলায় নদীতীরের একটি ছোট্ট গাঁয়ে তিনি একটি তোতাপাখিকে কী যেন বলতে শোনেন। পাখির ভাষা নয়, মানুষের। তোতাপাখি মানুষের ভাষা কণ্ঠে তুলে নিতেই পারে, কিন্তু এ যে ভিন্ন ও অপরিচিত ভাষা। এ পাখি কাকে শোনাচ্ছে তার কথা?

‘পাপিয়া আজ কেন ডাকে সখি, পিয়া পিয়া
শুনি পিয়া পিয়া বোল করিছে আমার হিয়া।’
হামবোল্ট পাখির ডাক অনুসরণ করেন আর গ্রামের মানুষকে একের পর এক জিজ্ঞেস করেন—পাখিটা কী বলছে? কেউ জবাব দিতে পারে না, এমনকি দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতালব্ধ বৃদ্ধরাও না। সে গাঁয়েই অভিযাত্রা ‘হল্ট’ করে গবেষণায় মন দিলেন তিনি। শেষ পর্যন্ত বের করলেন, তোতার মুখের ভাষা পাখপাখালির নয় সত্যি, আবার দূরের কোনো মানুষের ভাষাও নয়। ভাষাটি ঠিক এখানকারই এটিওর্ম ভাষা। দুই শতাধিক বছর আগে হারিয়ে গেছে। মানুষ মনে রাখেনি। কিন্তু পাখিরা মনে রেখেছে, পাখিদের প্রজন্মকে শিখিয়েছে। পাখিকে অনুসরণ করে তিনি এই ভাষার অস্তিত্ব ও বিলুপ্তির কথা জানিয়ে গেছেন।

ঘুমের মধ্যে ভাষার মৃত্যু
দুর্বল ও দরিদ্রের ঠাঁই পৃথিবীর কোথাও হয়নি—জীবন ও জীবিকার অন্বেষণে তাদের ছুটে বেড়াতে হয়েছে অস্থায়ী আশ্রয়ের সন্ধানে। কৃষ্ণসাগরের পূর্ব উপকূলে দেড় শ বছর আগে উবিখ ছিল একটি প্রাণচঞ্চল ভাষা। এই ভাষা উবিক্স নামেও পরিচিত ছিল। ১৮৬৪ থেকে অল্প সময়ের ব্যবধানে রুশ জাতীয়তাবাদীরা উবিখদের নির্মমভাবে তাড়িয়ে দেয়। দল বেঁধে উবিখরা তুরস্কে প্রবেশ করে এবং প্রতিকূলতার মধ্যে সেখানে বসতি স্থাপন করে। বেঁচে থাকার জন্য তাদের দ্রুত তুর্কি ও আঞ্চলিক ভাষার সঙ্গে সখ্য স্থাপন করতে হয়। দৈনন্দিন ব্যবহার্য শব্দগুলো প্রথমেই হটিয়ে দেয় উবিখের নিত্যকার শব্দ। ধীরে ধীরে গ্রাস করে নেয় গোটা ভাষাটিকেই। উবিখরা রুশদের হাতে বিতাড়িত হয়ে তুরস্কে হাজি ওসমান, হাজি ইয়াকুব, কার্কপিনার এবং মাসুকি নামের চারটি গ্রামীণ বসতি স্থাপন করে। ধীরে ধীরে জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ভৌগোলিক দখল বাড়তে থাকে সত্যি, হারাতে থাকে নিজেদের ভাষা ও সংস্কৃতি। তার পরও একজন ছিলেন তাইফিক এসেন, তিনি উবিখ ভাষা ব্যবহারে সক্ষম ছিলেন। একটি ভাষায় একজন মাত্র সক্ষম প্রতিনিধি হওয়ার কারণে তাঁর ছিল ‘সেলিব্রিটি’র মর্যাদা। ৭ অক্টোবর ১৯৯২ তিনি ঘুমের মধ্যেই মৃত্যুবরণ করেন। তাঁকে সমাহিত করার সঙ্গে সঙ্গে সমাহিত হলো আরও একটি ভাষা। তাইফিকের গুরুত্বপূর্ণ অবদান, ইউরোপীয় ভাষাবিশেষজ্ঞদের সঙ্গে জোট বেঁধে তাঁর ভাষার হাজার হাজার পাতার কাহিনি লিপিবদ্ধ করিয়েছেন, রেকর্ড করিয়েছেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে উবিখ কথকতা।
নরওয়েজিয়ান ভাষাবিশেষজ্ঞ হ্যানস ভোগত প্রকাশ করেছেন উবিখ ভাষার অভিধান, ফরাসি ভাষাবিদ জর্জ দুমেইল উবিখ ভাষারও প্রধান ভাষাবিদ এবং উবিখ লোকসাহিত্যের সংকলনকারী। ১৯৮০-এর পর থেকে ভাষাটির আর কোনো সম্ভাবনা দেখতে না পেয়ে তাইফিকও হতাশ হয়ে পড়েন। এখন উবিখ বড়জোর গবেষণার বিষয়। এই ভাষায় কেউ আর ‘মা’ ডাকে না।

নেই কেল্টিক ভাষা, কেল্টিক সংস্কৃতি
অ্যাংলো স্যাক্সনদের অনেক আগেই কেল্টরা ব্রিটেনে বসতি স্থাপন করে। তাদের ভাষা ও সংস্কৃতির বিনাশও হতে থাকে। কিন্তু অ্যাংলো স্যাক্সন আগ্রাসন তাদের পিঠ দেয়ালে ঠেকিয়ে দেয়। পদ্ধতিগতভাবে আইনি ব্যবস্থার মাধ্যমে তাদের গেইলিক ভাষা অপসারণ করে ইংরেজি প্রতিস্থাপন করা হয়। গেইলিক ভাষা ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৫০ হাজারের নিচে নেমে গেছে এবং এই ক্রমহ্রাসমান ধারা অব্যাহত রয়েছে। ভাষাগবেষক রিচার্ড মরিসন বলেছেন, স্কটল্যান্ডে ইংরেজ শাসনের অবসান ঘটে স্বশাসনের দিন এগিয়ে আসছে। কিন্তু স্বাধীন স্বশাসিত স্কটিশরা তখন দেখবে, স্বাধীন হয়েছে ঠিকই কিন্তু হারিয়েছে নিজেদের ভাষা ও সংস্কৃতি। ইংরেজি ভাষাই তাদের শাসন করছে।

খবরটি পড়ে ভালো পিনিক্স পাইলাম। তাই প্রথম আলো থেকে সরাসরি কপি পেস্ট মারলাম। original link

No comments:

Post a Comment

Comment here if you have anything to ask me. Please do not spam.